আমার ছোটবেলার ঈদ: নিলুফার করিম

আমার ছোটবেলা কেটেছে (১৯৬১ -১৯৭১ মার্চ পৰ্যন্ত) বর্তমান শের এ বাংলা কৃষি বিশ্বাবিদ্যালয় ক্যাম্পাস (তদানীন্তন তেজগাঁও কৃষি কলেজ ) এ আব্বার চাকুরীর সুবাদে |আব্বা ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমদ সেই কলেজে প্রফেসর ছিলেন , ৬৭ এর পরে ছিলেন হর্টিকালচারিস্ট পাশা-পাশা টিচিং ছিল। এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট সেখানেই ছিল। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে জয়দেবপুর চলে যায় , নামকরণ হয় বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ( বারি)।

ঈদ সত্যি ই ছিল আনন্দের দিন…

ঈদ এর পোষাক

ফ্রক পড়া বয়স পৰ্যন্ত আম্মা ই ঈদ এর জামা সেলাই করতেন | আম্মা দিনের বেলা সেলাই করলে পাহারা দিতাম আর রাতে সেলাই করলে দেখতাম যাতে কাপড়ের কোনো টুকরা যেন কোথাও পরে না থাকে বা কেউ যেন দেখে না ফেলে | ঈদ এ নতুন কাপড় পরে সবাইকে সারপ্রাইজে দেবার প্রচেষ্টা | নিউ মার্কেট এ যেতাম কাপড় কিনতে আম্মার সাথে বেবি ট্যাক্সি করে | একেক ঈদে নতুন ধরণের কাপড় উঠতো , দু একটা নাম মনে পড়ছে – ব্রোকেড , চিকেন , মুনলাইট ইত্যাদি | সেগুলো কেনার জন্য বায়না ধরতাম | নতুন জুতা ও পেতাম বছরে ওই একবার ই |একটু বড় হয়ে যখন সালোয়ার কামিজ পড়া শুরু করি তখন নিউ মার্কেট এর দর্জির কাছে যেতাম ঈদ এর কাপড় বানাতে | ছেলেদের কাপড় ও আম্মাই কিনতেন | আব্বাকে নিয়ে কখনো মার্কেট এ গিয়েছি মনে পরে না |
এই ঈদের কাপড় টি ই ছিল সবেধন নীলমনি , সারা বছর ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান বা বিয়ে শাদীতে পরে যাবার জন্য এই একটি ই ড্রেস ছিল | খুব যত্ন করে রাখতাম ড্রেস টি | কুরবানী ঈদে যেহেতু অনেক খরচ তাই ড্রেস পেলেও সাধারণ মানের আবার অনেক সময় পেতাম ও না | প্রফেসর বাবার ৫ ( আরেকজন স্বাধীনতার পরে) ছেলে মেয়ে ও জয়েন্ট ফ্যামিলির দেখাশুনা করে এর বেশি দেবার ক্ষমতা ও ছিল না | নিকট আত্মীয় দের কাছ থেকে কাপড় পেয়েছি মনে পরে না | এটার তেমন চল ছিল না | শুধু বড় খালাম্মা র কাছ থেকে ঈদি পেতাম | ( ওনারা হাজারীবাগ থাকতেন , খালু ওখানকার ডাক্তার ছিলেন | পুরানো ঢাকার এই ট্রেডিশন টা খালাম্মা ওখান থেকেই পেয়েছিলেন ) | তাই ঈদ উপলক্ষে বড়ো খালাম্মার বাসায় যাবার আগ্রহ ছিল বেশ |
আমরা যা পেতাম তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম | কেননা , প্রতিবেশী সবাই প্রফেসর বা কলেজ এডমিনিস্ট্রিন এর অফিসার , একই ধরণের আয় , কাপড় -চোপড় বা সাজ -পোশাক একই মানের | কখনো মনে হয়নি যে “ওদের আছে আমাদের নেই “|

মেহেন্দি পড়া

২৭ এ রমজান এ আমরা সবাই মানে পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা , আমি , আমার ভাই বোন- বুলবুল , শামীম ,নাজনীন , মনসুর চাচা র মেয়েরা -জেসমিন, পারভীন (পাব্বু) , তাসমিনা (তাস্সু ) , তুহিন , আইরিন ; মোসলেহউদ্দিন চাচার মেয়েরা – সালমা , শামীম আর ইয়াসমিন , কুদ্দুস চাচার মেয়েরা -মোনা আর লিসা , গোলাম মাহবুব চাচার মেয়েরা – নাহার আপা , শেফালী আপা , খুকি , রোজি , মঈন চাচার মেয়েরা – বাবুল আপা , নাজমা , বিল্লি , মুন্সী সিদ্দিক আহমেদ চাচা র মেয়েরা – লিপি , মুন্নি – আরো অনেকে একত্রিত হতাম তৎকালীন প্রিন্সিপাল ফরিদ সাহেবের বাসায় | ওনার ৬ মেয়ে ২ ছেলে ছিল | ছোট চার্ মেয়ে আমাদের কাছাকাছি বয়সের | ওদের নামগুলোও খুব আদুরে. আন্নু, চুন্নু , কুক্কু আর গুল্লু |ছোট ছেলেগুলো আমাদের সাথে যোগ দিত |
সারা ক্যাম্পাস জুড়েই অনেক মেহেন্দি গাছ | সবাই মিলে সংগ্রহ করা মেহেন্দি বাটা হতো , একজন আরেকজন কে পরিয়ে দিতাম | এখনকার মতো design ছিল না , কিন্তু খেজুরের কাটা বা নারিকেল এর পাতার কাঠি দিয়ে ডিজাইন করতাম | ছেলেরা কানি আঙ্গুল এ ও হাতের পাতায় ছোট গোল করে মেহেন্দি পড়তো | আম্মাদের জন্য বাসায় নিয়ে আসতাম | আম্মা রাতের বেলা রান্না বান্না , নামাজ , খাওয়া দাওয়া সেরে মেহেন্দি পড়তেন | আব্বার কানি আঙ্গুল ও পড়িয়ে দিতাম মেহেন্দি |

ঈদ এর চাঁদ দেখা

২৯ রোজার দিন সন্ধ্যা ইফতার হাতেই বাড়ির সামনে মাঠে জড়ো হতাম সবাই | মানসুর চাচা ঘোষণা দিতেন , যে সবার আগে চাদ দেখবে তার জন্য ১০ টাকা পুরস্কার | সবার আগে চাদ দেখার সে কি প্রচেষ্টা |একবার আমি পেয়েছিলাম ১০ টাকা , কি আনন্দ | তখনকার ১০ টাকার দাম ও ছিল |
তখন পশ্চিম পাকিস্তান এ চাঁদ দেখা গেলে আমাদের এখানে (পূর্ব পাকিস্তান ) ঈদ করতে হতো | এক দেশ বলে কথা |একবার ২৯ রোজায় চাঁদ দেখা গেলো না , কিন্তু সেহেরি খেতে উঠে জানা গেলো সেদিন ঈদ হবে , পশ্চিম পাকিস্তান এর কোথায় নাকি চাঁদ দেখা গেছে | আম্মা র সেই ভোর রাতেই রান্না -বান্না শুরু করতে হলো |

ঈদ এর দিন

ঈদ এর দিন খুব ভোরে উঠে সবাই গোসল করে নুতুন কাপড় পড়ে নিতাম | ছোট ভাই বোনদের সাজিয়ে দেবার দায়িত্ত ছিল বড়ো বোনদের | বুলবুল আর আমি ঘর গুছিয়ে ফেলতাম | সেদিন বিছানায় ভালো চাদর আর বেডকভার বিছানো হতো , আর বসার ঘরে দেয়া হতো আম্মার হাতের কাজ করা কুশন কভার আর টেবিল ক্লথ | ডাইনিং টেবিলে নাস্তা রেডি হয়ে যেত – জর্দা , ফিরনি , সেমাই , পুডিং , পরোটা/ চালের রুটি , কাবাব , গোশত ভুনা ইত্যাদি | নামাজ পড়ে এসেই যেন সবাই নাস্তা খেতে বসতে পারে | ( আম্মার রান্নার তুলনা ছিল না বিশেষ করে পুডিং আর ফিরনি ) | আম্মা ঘরে গরু আর হাঁস-মুরগি পালতেন বলে দুধ আর ডিমের তৈরী খাবার এ আম্মা কোনো কার্পণ্য করতেন না |
মোটামুটি সব রান্না সেরে আম্মাও গোসল করে রেডি হয়ে যেতেন, পড়তেন একটা পাড় ওয়ালা পাবনা বা টাঙ্গাইল সুতির শাড়ি , আম্মার লম্বা চুল গামছায় বাধা থাকতো কিছুক্ষন ( মনে পড়ে খুব মনে পড়ে )| কি অসাধারণ সুন্দর লাগতো আম্মা কে |
নামাজ পড়ে আব্বার সাথে পাড়ার চাচা রা ও অনেকে আসতেন , নাস্তা করে ড্রয়ইং রুমে বসে গল্প করতেন |
আমরাও ততক্ষনে রেডি হয়ে দল বেঁধে এক বাসা থেকে আরেক বাসা ঘুরতাম | আব্বার কলিগ দের কে চাচা ডাকলেও ওনাদের ওয়াইফ দের কে খালাম্মা ডাকতাম | আম্মা মজা করে বলতেন , তোমাদের সব চাচারা -খালাদের কে বিয়ে করেছে !
দুপুরের মধ্যে বাসায় ফিরে আসতাম | দুপুরের খাবারে থাকত পোলাউ , মুরগির কোর্মা আর ঝোল ঝোল ঝাল মাংস আলু দিয়ে | আম্মা ঘরে ই ঘি বানাতেন , কি যে তার সুগন্ধ| | পোলাউর সেই গন্ধ যেন আর পাই না |বড় ফুফু , ফুফা ( প্রিন্সিপাল মো: ইসহাক ) আর ফুফাতো ভাই বোনেরা আসত আমাদের বাসায় দুপুরে , আর আমরা আবার যেতাম রাতে ওনাদের বাসায় | কখনো বা পরের দিন দুপুরে | তবে আমি আমার ছোট ফুফাত বোন , শিরিন আপা র ( আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় , পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বছর আটক আগে ) সাথে চোলে যেতাম ফুফুর বাসায় | ঢাকা টিচার্স ট্রেনিঙ কলেজের সামনে অনেক বড় জায়গা নিয়ে বাড়ি টি , নাম কলেজ ভিউ | এখনো বাড়িটি আছে , তবে সামনে দোকান পাট থাকতে আর দেখা যায় না | বিকেল হবার আগেই পাড়ার সব মেয়েরা জড়ো হতাম প্রিন্সিপাল ফরিদ সাহেবের বাসায় | আমাদের আসর বসতো | ডুপ্লেক্স বাড়ি , নীচে ড্রয়িং কাম ডাইনিং এর মাঝে পর্দা টানা | ডাইনিং টেবিল সরিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো | যে যা পারতো তাই করতো | আমি থাকতাম অনেক ভূমিকায় -উপস্থাপনা , গান ও আবৃতি করা |প্রিন্সিপাল ফরিদ সাহেব রা ইন্ডিয়া র UP থেকে আগত নন বাঙ্গালী ছিলেন | আন্নু , চুন্নু রা খুব ভালো উর্দু গান গাইত| ওদের বাসায় অনেক কিসমিস আর পেস্তা বাদাম দেয়া ঝরঝরে শুকনো সেমাই আর চানাচুর খেতে দিত | শিরিন আপা ও থাকত আমাদের সাথে | গল্প , আড্ডা আর নাচে গানে কিভাবে যেন ২/ ৩ গঘন্টা কেটে যেত | সন্ধ্যে লাগার আগেই বাসায় ফিরতাম | তারপর রেডি হয়ে সদলবলে বড় ফুফুর বাসায় | বড় ফুফুর বাসার আকষর্ন ছিল আমার অনেক গল্পের বই আর বলাকা হলে সিনেমা দেখা ফুফাতো ভাই বোনদের সাথে | ভীষণ গল্পের বই পড়তাম আমি |
এভাবে শেষ হয়ে যেত অতি প্রতীক্ষিত আনন্দের একটি দিন |

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (রাত ৪:০৪)
  • ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০