বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, বর্তমান সরকার কাউকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মিটিং-মিছিল করতে দিচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের দিন সরকারি দল পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের জন্য একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার।
বুধবার (২ আগস্ট) দুপুরে দেশে বিদ্যমান সংঘাতমুখর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার এবং কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধানের দ্বারা। সংবিধান জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়ে যে নিশ্চয়তা দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হচ্ছে প্রশাসনের। এসব অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হলে সে ব্যাপারে আইনি প্রতিকার পাওয়ার স্থান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, জামায়াত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী একটি রাজনৈতিক দল। সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব থাকা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতের বিজয় প্রমাণ করে যে, জামায়াত দেশের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে এবং জামায়াতকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার অপকৌশল হিসেবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াতের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে কিছু অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি রিট দায়ের করেন।
২০১৪ সালের ১ আগস্ট উচ্চ আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনটি আইন সম্মত হয়নি বলে রায় প্রদান করেন।
রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে সংবিধানের ৩৮, ৩৯ এবং ৪১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামী আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। জামায়াত আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং সম্মান রেখে তার আপিল আবেদনে উল্লেখ করেছে যে, উচ্চ আদালতের রায়টি সংবিধানের মৌল কাঠামোর পরিপন্থি।
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানে বর্ণিত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের অধিকারের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন এবং আমরা আশা করি, জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় জামায়াতের নিবন্ধন মামলা নিয়ে সরকার সমর্থিত কতিপয় ব্যক্তি নানাভাবে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করছে। তারা আইন, আদালত, সংবিধান এবং দেশের প্রচলিত সিস্টেমকে অগ্রাহ্য করে আদালতের বিচার্য বিষয়ের ইস্যুগুলো বাইরে আলোচনায় টেনে এনে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। উচ্চ আদালতে জামায়াতে ইসলামী আপিলকারী এবং আপিলের বিষয় বস্তু হচ্ছে নিবন্ধন। নিবন্ধন সঠিক না বেঠিক কিংবা তার আইনি ফায়সালা কী তার নিষ্পত্তি করা আদালতের দায়িত্ব। অথচ জামায়াতে ইসলামীর দায়ের করা আপিলের বিষয়বস্তুর বাইরে কিছু লোক আদালত অবমাননা এবং জামায়াতকে রাজনীতি করতে না দেওয়ার পিটিশন দায়ের করা সংক্রান্ত বিষয়গুলো মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনগণের মধ্যে একটি উসকানিমূলক পরিবেশ তৈরি করছে।
আমরা সর্বদাই বলে আসছি, বিচারাধীন বিষয়ে আদালতের বাইরে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ সম্পর্কে আজ রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ কথা বলছে। কোনো কোনো অতি উৎসাহী কর্মকর্তা বলছেন, যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন নেই, তাই জামায়াতের রাজনীতি করারও সুযোগ নেই। এই বক্তব্যগুলো সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি। আমরা এসব বেআইনি, অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক আলোচনা পরিহার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
জামায়াতে ইসলামী একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। জামায়াত সব সময়ই শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নে অভ্যস্ত। জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। এ অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলকে এ অধিকার দিয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, জামায়াতকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না দিয়ে জামায়াতের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। বিগত ১৫ বছর যাবত জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য সব ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে এ সরকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং দলীয় লোকদের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের ব্যবস্থা করে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করে তা কার্যকর করেছে।
বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে দীর্ঘ দিন যাবত কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে বারবার জামিন পাওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের মুক্তি দিচ্ছে না। সরকার তাদের মুক্তি না দিয়ে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এবং অব্যাহতভাবে আদালত অবমাননা করে চলছে। কারাগারে আটক থাকাবস্থায় বাইরে সংঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে মামলার আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
জামায়াতের এ নেতা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অধিকারের ব্যাপারে নিবন্ধিত/অনিবন্ধিত বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করার অধিকার রাখে। বাংলাদেশে বহু অনিবন্ধিত দল সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু জামায়াত অতীতের প্রায় প্রত্যেকটি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল হওয়া সত্ত্বেও সমাবেশ করার সহায়তা পাচ্ছে না। এটা জামায়াতের প্রতি চরম অবিচার। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে যে আচরণ করছে, জামায়াতের সাথে তার বিপরীত আচরণ করছে। এটা কোনো আইনের দ্বারা সমর্থিত নয়।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু সরকার জনগণের দাবি অগ্রাহ্য করে এক তরফা নির্বাচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ষড়যন্ত্রে বিভোর। এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাত ৯টা পর্যন্ত সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার তার দলীয় লোকদের দ্বারা নানা অপপ্রচার চালিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলাটির বিষয়ে এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির অবতারণা করছে।
সরকারের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী ঘোষিত ৪ আগস্টের সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল করে তোলার জন্য আমরা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করছি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আ.হালিম, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর আ.রহমান মুসা।