দেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে চিকিৎসার জন্য ২৫০ শয্যার কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ওষুধ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকার বিল হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণে ঘুরেফিরে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক একই পরিবারের সদস্য।
হাসপাতালের ওষুধসহ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (এমএসআর) সরবরাহ জিম্মি থাকার অভিযোগ আমলে নিয়ে ছদ্মবেশে রোগী সেজে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় থেকে অভিযান চালিয়ে অভিযোগের অধিকাংশের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। চলছে নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ।
বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, কুড়িগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে টেন্ডার বাণিজ্য এবং হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম দুদক কার্যালয় থেকে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে।
দুদক জানায়, এনফোর্সমেন্ট টিম ছদ্মবেশে রোগী সেজে হাসপাতালের ফার্মেসিতে ওষুধ সংগ্রহে গেলে হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে টোকেনে উল্লিখিত ওষুধের থেকে কম পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করে। পরে টিম কুড়িগ্রামের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ককে ওষুধ সরবরাহে অনিয়মের বিষয়টি অবগত করে। এছাড়াও টিম ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ের বিষয়ে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের টেন্ডার সম্পর্কিত যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে এবং হাসপাতালের স্টোর পরিদর্শন করে।
স্টোর পরিদর্শনে দুদক টিম দেখতে পায়, ঠিকাদারের মাধ্যমে হাসপাতালে সরবরাহ করা ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের স্টক রেজিস্টারে তথ্য আপডেট করা হয়নি। পরে সংগ্রহ করা রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে টিম দ্রুত কমিশনে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানা গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে মেডিসিন ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের (এমএসআর) টেন্ডার প্রক্রিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর থেকে গত আট বছর ধরে রাজশাহীর এক পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এমএসআর পণ্য সরবরাহ।
২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এমএসআর টেন্ডারের কার্যাদেশ পায় রাজশাহীর ‘মেসার্স টোটন ফার্মেসি’। এর মালিকের নাম মো. নাসিমুল গণি খান (টোটন)। এর পরের বছর একই ঠিকাদার (টোটন) প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’ নামে কার্যাদেশ পান। এরপর টানা তিন বছর একই নামে এমএসআর পণ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ রাখে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কিছুটা কৌশলী হয়ে টোটন তার শ্যালক জাহিদুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ’সহ যৌথভাবে এই টেন্ডারের কার্যাদেশ পান। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আবারও এককভাবে কার্যাদেশ পায় টোটনের ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। পরের বছর (২০২১-২০২২) শ্যালকের স্থলে নিজের বড় ভাই রফিক উদ্দিন খানের ‘মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজ’সহ যৌথভাবে আবারও কার্যাদেশ পায় ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স।
বিতর্ক এড়াতে পরের বছর (২০২২-২০২৩) আরও কৌশলী হয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয় টোটনের বড় ভাই ও শ্যালকের নামে। গত বছর এমএসআর টেন্ডারে প্রায় ১২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। ঘুরেফিরে একই পরিবারের হাতে জিম্মি থাকা এমএসআর টেন্ডারে সরবরাহ করা পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছু ওষুধ সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে।