কাটা হচ্ছে হালদার চর-মাটি যাচ্ছে ইটের ভাটায়: নষ্ট হচ্ছে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ

 

শাহাদাত হোসেন, রাউজান (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধিঃ

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর পাড়ে গড়ে উঠা শান্তি ব্রীকস নামে ইটভাটা হালদা নদীর চরের মাটি গিলে খাচ্ছে।রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের পশ্চিম আবুরখীল এলাকায় পুরাতন হালদা নদীন চর,ছায়ার চর, হালদার চর থেকে গভীর রাতে ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে যান্ত্রিক নৌযানে হালদা নদী দিয়ে ইটের ভাটায় এনে স্তুপ করে ইট তৈরির জন্য।ইট তৈয়ারি কাজে ব্যবহৃত জালানী কাঠ, কয়লা যান্ত্রিক নৌযানে হালদা নদী দিয়ে পরিবহন করা হয়।যান্ত্রিক নৌযান চলাচল করায় হালদা মাছসহ জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। যান্ত্রিক নৌযানের আঘাতে মা মাছসহ হালদার মধ্যে থাকা ডলফিন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।হালদা নদীর মা মাছের প্রজনন ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার যান্ত্রিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধি করলেও হালদার তীরে গড়ে উঠা ইটভাটার মালিকরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হালদায় জেগে উঠা চরের মাটি কেটে যান্ত্রিক নৌযানে পরিবহন করছে প্রতিনিয়ত।হালদা নদীর তীরে গড়ে উঠা তিনটি ইট ভাটায় ইট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে হালদা নদীর চর কাটা মাটি।ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়াই হালদা নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।হুমকির মুখে পড়েছে নদীর মা মাছসহ জীব-বৈচিত্র্য ।এবিষয়ে শান্তি ব্রিকসের মালিক প্রিয়তোষ চৌধুরী বলেন,ইটেরভাটায় ইট তৈরির জন্য আনা মাটি হালদা নদীর চর কাটা মাটি নয়।পুরাতন হালদা নদীর পাশে আমার নিজস্ব জায়গা থেকে মাটি কাটা হচ্ছে।হালদা গবেষক ড.শফিকুল ইসলাম জানায়,
বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ নামে পরিচিত হালদা নদী বাংলাদেশের স্বাদুপানির মেজরকার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্রে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন ও অন্যান্য জলজ প্রাণি।
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে কার্প জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারের গেজেট অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ এলাকায় ১২টি শর্ত কার্যকর হবে। যার একটি শর্ত হচ্ছে ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট/ পরিবর্তন করতে পারে, এমন সব কাজ করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে হালদার বাস্তুতন্ত্র হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। যার ফলশ্রুতিতে বিগত দুইবছরে (২০২১ ও ২০২২) সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ অতীতের তুলনায় অপ্রতুল।তিনি জানান, বর্তমানে মনুষ্যসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় হালদা নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকি সম্মুখীন। হালদা নদীর রাউজান অংশের উরকিরচর ইউনিয়নের পশ্চিম আবুরখীলের হালদার তীরে শান্তি ব্রীকস, হারপাড়া এলাকার আজমীর ব্রীকস ও নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামী পাড়ার এ আলী ইটভাটার জন্য হালদার তীরে জেগে উটা চর থেকে ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে ইঞ্জিন চালিত নৌকা করে ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য স্তুপ করা হচ্ছে।নদীর চর কাটার ফলে নদীতে ভাঙ্গন সৃষ্টি,পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়। জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, ফসল ও গাছপালা মারা যায়।পরিবেশের পাশাপাশি নদীর জীববৈচিত্র্য ও হুমকির মুখে পড়ে। ইট ভাটার প্রধান জ্বালানি হচ্ছে কাঠ ও কয়লা এবং কাঁচামাল হচ্ছে মাটি। জ্বালানীর জন্য অনেক বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে ফলে প্রানিদের নিরাপদ আবাসস্থল বিলুপ্ত ও পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, সারাদেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ৮০৩৩টি। ভুমি মন্ত্রনালয়ের মতে, প্রতিবছের গড়ে ৮২০০০ হেক্টর ভুমি আবাসন ও ইটভাটার জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে।পরিসংখ্যান মতে প্রতি বছরে ৩৩০৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট মাটি ইট তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে। ইট ভাটায় মাটির উপরের অংশ যেখানে জৈববস্তুর (ক্যালসিয়াম) পরিমাণ বেশি তা ব্যবহার করা হয় এবং পোড়ানো হলে কার্বনডাই-অক্সাইড তৈরি করে।ইট পোড়ানো হলে প্রচুর ধোঁয়া, ছাই ও দুষিত পদার্থ (পার্টিকুলেট ম্যাটার, সাসপেন্ডেট ম্যাটার, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বনডাই-অক্সাইড ও সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্্রাইড) বায়ুমন্ডলে যায়। গ্রীন হাউস প্রভাবের জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইডের অন্যতম উৎস হচ্ছে ইটভাটা। ইট পোড়ানের ফলে প্রতিদিন উৎপন্ন হচ্ছে প্রচুর পরিমান কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস। একটি ইট পোড়ানো হলে ৪২৮ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে যায়। যা বায়ুদূষণ ও বৈশ্বিক উন্চতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এছাড়া ইটভাটার সৃষ্ট তাপ আশেপাশের অঞ্চলে ফসলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।উৎপাদিত ছাই পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি করে যা জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র ও জলজ প্রাণির জন্য মারাত্মক হুমকি। ফলে পরিবেশ ধ্বংস, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট, ও বায়ু ও পানিদুষণ ইত্যাদি ঘটছে। এছাড়াও ইটভাটার চারপাশের মানুষের স্বাহের হুমকি যেমন শ্বাসকষ্ট, চোখ, কান, অ্যাজমা, হার্ট অ্যাটাক, শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা, ফুসফুস ক্যান্সার, গলার সমস্যা, চুলকানি, অ্যালার্জি, হাঁপানি ও চর্মরোগের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড এসিড বৃষ্টি হয়ে ফসলের ও নদীর জলজ জীবনের জন্য হুমকি।তিনি বলেন বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন -২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা,পাহাড়, বন ও জলাভুমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনে ইটভাটা নির্মাণ করা যাবেনা।এমনকি কৃষিজমিতে ও ইটভাটা নির্মাণ অবৈধ। ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেনী পরিবর্তন করা ও সম্পুর্নভাবে নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ।ইট উৎপাদন পদ্ধতি ফিক্সড চিমনি, জিগজ্যাগ, হাইব্রিড হফম্যান কিন, ট্যানেল, ভার্টিকেল শ্যাফট ক্লিন পদ্বতি। ফিক্সড চিমনি সবচেয়ে পুরনো পদ্ধতি যা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত পদ্ধতি যেখানে ১২০ ফুট লম্বা চিমনি দিয়ে বায়ুমন্ডলে ধোঁয়া নির্গমন করা হয়। টানেল পদ্ধতি সবচেয়ে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধ

(ইকোফ্রেন্ডলি) পদ্ধতি এতে খুবই অল্প ধোঁয়া সৃষ্টি হয় ফলে কার্বনের ঝুঁকি কম ও মাটি আশ্রয় ৭০% ও ইট উৎপাদনে সময় অনেক কম লাগে। ইট ভাটার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে সংরক্মনে অর্থাৎ হালদার বাস্তুতন্ত্রকে জলজ প্রানির জন্য নিরাপদ করার জন্য পুরনো পদ্ধতি বাদ দিয়ে পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা গড়ে তুলতে হবে ও এসব ইটভাটা মনিটরিংয়ের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আজকের দিন-তারিখ
  • মঙ্গলবার (ভোর ৫:০২)
  • ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ৫ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
  • ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (শরৎকাল)
পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১