নারী সাংবাদিকতার অগ্রপথিক

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। যেসব নারী ইতিহাসের পাতায় নাম লিখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ছিলেন একজন সূর্যসন্তান। ছিলেন একজন সাহসী মানুষ। তাঁর জন্ম ফেনীতে ৩১ মার্চ, ১৯৩১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকায় অবস্থানরত ছিলেন৷ বাংলাদেশকে পঙ্গু করতে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার, পাকিস্তানিরা যেসব মেধাবী সন্তানকে হত্যা করেছিল তাদেরই একজন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিন। তিনি ১৯৬৯ সালে বের করেন শিলালিপি নামে একটি পত্রিকা। নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন৷ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সকলেরই নজর কাড়ল৷

শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি৷ কিন্তু শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার৷ পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মিলল তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে৷ সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো তার মতো করে প্রকাশ করেছিলেন। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন৷ কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান৷ যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার পক্ষের লেখা৷ তা-ই কাল হলো৷ শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন৷

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। মা, ছেলে সুমন, আর ভাইকে নিয়ে থাকতেন ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তাঁর বাড়িতে। শহরে তখন কারফিউ, রাস্তায় মিলিটারি।

সেদিন শীতের সকালে তাঁরা সবাই ছাদে ছিলেন। সন্তান সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে সেলিনা বললেন যাও বাবা এবার একটু খেল, আমি লিখব। এই বলে সেলিনা চেয়ার টেনে লিখতে বসলেন। তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক কলম সৈনিক। সেসময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সাহসী সব লেখা লিখতেন, প্রকাশ করতেন শিলালিপিতে। মতো প্রকাশে স্বাধীনচেতা নারী। ভয় শব্দটা তাঁর কাছে থেকে দূরেই থাকত বলা যায়। সেলিনা লিখছিলেন, এমন সময় তাঁর দরজায় কড়া নাড়ে কিছু লোক। তাদের মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা ছিল এবং সবার পরনে ছিল একই রঙের পোশাক। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সঙ্গে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়।

মুখ ঢাকা লোকগুলো তাদের সঙ্গে সেলিনা পারভিনকে নিয়ে যেতে চাইলে পারভিন বলেন, বাইরে তো কারফিউ। তারা বলে, আমাদের সঙ্গে গাড়ি ও পাশে আছে। ছেলে সুমন তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। সেলিনা পারভিন বলেন, না বাবা, তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিয়ো, আমি যাব-আর আসব। এটাই ছেলের সঙ্গে তাঁর জীবনের শেষ কথা। কোমরের গামছা দিয়ে চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বেঁধে সেলিনা পারভীনকে নিয়ে যায় আলবদরেরা। তিনি আর ফিরে আসেননি।

১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। তাঁর সারা শরীরে ছিল নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন। চেহারা এমন ভাবে বিকৃত করেছিল যে তাকে চেনার উপায় ছিল না। ঘৃণিত আলবদর, নরপিশাচেরা তাদের কার্যের দাগ রেখে গিয়েছিল। তাঁর চোখ বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে ছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। শীতকাতুরে সেলিনার পায়ে তখনো পরা ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাঁকে শনাক্ত করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর লাল-সবুজ পতাকা উড়েছিল। শহীদ সেলিনা পারভিন সেই আলোয় রাঙা ভোর দেখে যেতে পারেননি। এই পতাকার লাল বৃত্তের মাঝে লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে তাঁর রক্তের দাগও মিশে আছে।
এই স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের বিনিময়ে। যোদ্ধারা হারায় না। তাঁরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে যায়। তাঁদের মানুষ স্মরণ করে অন্তরের অন্তস্তল থেকে। ৩১ মার্চ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধার সঙ্গে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (বিকাল ৫:২৮)
  • ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১