সোনারগাঁয়ে ভয়ংকর ‘চায়না দুয়ারী’র ফাঁদে বিলুপ্ত হবে দেশীয় মাছ

মাজহারুল রাসেল : সোনারগাঁ উপজেলার ছোট-বড় নদী, খালের বিভিন্ন স্থানে চায়না দুয়ারী নামের বিশেষ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে নির্বিচারে দেশীয় প্রজাতির মাছ শিকার করছে স্থানীয় জেলেরা। খুব সহজে বেশি মাছ ধরার এই ফাঁদের ব্যবহারে ভবিষ্যতে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি ঘটাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনকে জানানো হলেও বন্ধ হচ্ছে না চায়না দুয়ারীর ব্যবহার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মাছের প্রজনন মৌসুমে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের পর এবার ভয়ঙ্কর চায়না দুয়ারী নামক ফাঁদে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা হচ্ছে। সহজেই সব মাছ ধরতে নদী-খাল জুড়ে জেলেরা অহরহ ব্যবহার করতে শুরু করেছে এই জাল। এই ধরনের ক্ষতিকর ফাঁদ ব্যবহার বন্ধে মৎস্য বিভাগের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় সংশ্লিষ্টরা অভিযান চালিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মৎস্য আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা প্রয়োগ করে মৎস্য বিভাগ নিয়মিত নদীতে অভিযান পরিচালনা করার দাবি উঠেছে।
নদীতে থাকা মিঠাপানির সব ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছ এই ফাঁদে ধরা পড়ছে। বিশেষ করে মাছের প্রজনন মৌসুমে বিলুপ্ত প্রায় ম্যাটর, পাবদা, কাজলী, ডিমওয়ালা চিংড়ি, পুটি, টেংরা, কই, সিং, মাগুর, বেলে, ছোট রিটা, বোয়াল, শোল, বাইন, টাকিসহ প্রাকৃতিক সব মাছ এই চায়না দুয়ারীতে নিধন হচ্ছে।
চায়না দুয়ারী সাধারণত এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতা ও ৬০ থেকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ক্ষুদ্র ফাঁশবিশিষ্ট ঢলুক আকৃতির হয়ে থাকে। লোহার চারটি রড ও রডের রিং দিয়ে খোঁপ খোঁপ আকারে বক্স তৈরি করে চারপাশ সুক্ষ জাল দিয়ে ঘিরে দিয়ে তৈরি করা হয়। এই ফাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো নদীর তলদেশে লম্বালম্বিভাবে লেগে থাকে। ফলে কোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য ছাড়াই দুদিক থেকেই মাছ ঢুকে আটকা পড়ে। তবে কেউ কেউ অতিরিক্ত মাছের আশায় ঘ্রাণ জাতীয় মাছের খাবার দিয়ে থাকে। একটি চায়না দুয়ারীর দাম (মান ভেদে) চার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
প্রথমদিকে এই ফাঁদ জেলেদের কাছে খুব একটা পরিচিত না থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অধিক মাছ শিকারের আশায় জেলেদের কাছে খুব অল্প সময়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। শুরুতে ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, মাগুরা, পাবনায় এই ফাঁদ তৈরি হলেও অতিরিক্ত চাহিদার কারণে বর্তমানে নদীবেষ্টিত সব এলাকায় এ জাল তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয় জেলেরা জানান, চায়না দুয়ারীতে সব ধরনের মাছ ছেঁকে উঠে, সহজেই মাছ ধরা যায় এবং দাম কম হওয়ায় বেশিরভাগ জেলে বর্তমানে এ দুয়ারী ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া অনেক মৌসুমী মৎস্য শিকারিরা এ দুয়ারী ব্যবহারে করে মাছ ধরতে নেমেছেন। ফলে যারা পুরনো কৌশলে মাছ ধরত, তাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে চায়না দুয়ারী কিনছেন।
উপজেলার বারদী ইউনিয়নের নুনেরটেক এলাকার নদী পাড়ের বাসিন্দা কবির জানান, বিকেল হলেই ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে এই চায়না দুয়ারী নদীতে ফেলা হয়। সারারাত নদীতে রাখার পর তুলে আনা হয় সকালে। এ সময় জালে ধরা পড়ে দেশীয় প্রজাতির সব মাছ। নদীতে থাকা জলজ প্রাণী এমনকি ছেঁকে উঠছে মাছের ডিমও। এ জাল দিয়ে মাছ ধরলে কিছুদিন পর হয়তো নদীতে কোনো মাছ পাওয়াই কঠিন হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চায়না দুয়ারী দিয়ে মাছ শিকারি জেলেরা বলেন, ‘চায়না দুয়ারী দিয়ে মাছ ধরা ঠিক না। তারপরও জীবিকার তাগিদে মাছ ধরি।’
সোনারগাঁ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘দেশি মাছ ধ্বংস করতে মাছ শিকারের মরণ ফাঁদ চায়না দুয়ারী নতুন সংযোজন। এই ফাঁদ বন্ধে মৎস্য আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। তাই চায়না দুয়ারী বাজারে বিক্রি বন্ধে কারেন্ট জালের মতো কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে নদীতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাছ ধ্বংসের ধারা প্রয়োগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আমরা সেভাবেই অভিযান পরিচালনা করছি। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে সব নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চলমান রয়েছে। এই ফাঁদ প্রতিরোধ করতে এবং জেলেদের নিরুৎসাহিত করতে আমরা উপজেলার সকল মাঠপর্যায়ে মৎস্য কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে উপজেলার বেশ কয়েকটি বাজারে চায়না দুয়ারী জব্দ করতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (দুপুর ১২:২০)
  • ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১