রাফিউ হাসান হামজাঃ চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় দরিদ্রের গভীর নলকূপ ধনীদের ঘরে ঘরে। উপজেলাজুড়ে নলকূপ বরাদ্দের নামে চলছে হরিলুট।
বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ পেতে সরকার নলকূপ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এর সুফল পাচ্ছে না শাহরাস্তির জনগণ। নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর তালিকার চূড়ান্ত নাম নিয়ে এখানে চলছে তুঘলকিকান্ড।
শাহরাস্তি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস গভীর নলকূপগুলো দিয়েছেন ব্যবসায়ী, ধর্নাঢ্য ব্যক্তি, সচ্ছলদের আবদ্ধ জায়গায় অথবা ঘরে বা উঠানে। অথচ সরকারী নীতিমালায় বলা আছে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকার বসবাসকারী এবং আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে নলকূপ স্থাপনে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কিন্তু উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের যৌথ হরিলুটে যেমন ইচ্ছা তেমন করে স্থাপন করছে গভীর নলকূপগুলো। ফলে অধিকাংশ নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। টাকার বিনিময়েও নলকূপ বরাদ্দের অভিযোগ রয়েছে অহরহ। যেসব এলাকায় সুপেয় পানির হাহাকার চলছে। গ্রীষ্মকালে যে সব এলাকায় পানি ওঠে না। যে সব এলাকায় সুপেয় পানির দীর্ঘদিন ধরে কষ্টে রয়েছেন সে সব এলাকায় নলকূপ বরাদ্দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের এবং অর্থের বিনিময়ের ও দলীয় নেতাকর্মীদের সুপারিশে নলকূপ বরাদ্দের কারণে ক্ষুদ্ধ বঞ্চিত দ্ররিদ্ররা। এতে উপজেলায় অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নলকূপ বিতরণে উপকারভোগীর তালিকা প্রস্তুত করলেও এগুলো অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় স্থানে স্থাপন করা হচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ মানুষ সরকারি নলকূপের উপকার ভোগ করতে পারছে না।
সূত্র জানায়, এই ২০২২-২৩ অর্থ বছরে শাহরাস্তি উপজেলায় ২৬০ টি টিউবওয়েল বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ ২৬ টি করে মোটর নলকূপ। চলতি বছরও সমান সংখ্যক নলকূপ বিতরণের তালিকা চূড়ান্ত করেছে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সরকারি এ সহায়তার নিয়ম হচ্ছে প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য একটি নলকূপ অথবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দেয়া হয়।
স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, সরকারি এসব গভীর নলকূপ ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় ও আবদ্ধ ঘরে বসানোর ফলে এর সুফল এলাকাবাসী পায় না। অনেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সরকারি এ সুবিধা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের উল্লাশ্বর গ্রামের পশ্চিম পাড়া আব্দুল হাই মেম্বারের বাড়িতে ৩ টি কল থাকার পরেও নতুন করে সেই বাড়িতেই বিল্ডিংয়ের সাথে একটি আর্সেনিকমুক্ত মোটর নলকূপ স্থাপন হচ্ছে। যার বাড়িতে মোটর নলকূপ বসানো হচ্ছে তার নাম মেহেদী হাসান, পিতা মৃত সিরাজুল ইসলাম। মেহেদী হাসান পূর্বে বর্তমান চেয়ারম্যানের নিকট কলের আবেদন করিলে তা বাতিল হয় উপজেলা থেকে। নিকটতম অনেক আর্সেনিক মুক্ত কল থাকার কারণে তার আবেদনটি বাতিল হয় বলে জানা যায়। অথচ এবার অজানা কারণেই তার বাড়িতে আর্সেনিক মুক্ত নলকূপ বসানো হচ্ছে।
একই বাড়ীর ১০ মিটারের মধ্যে হাবীব উল্যাহ, ১২ মিটারের মধ্যে আবুল বাসেদ,
২৫ মিটারের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের নামে কল বরাদ্দ হলেও পাশের ৩ বাড়ীতে নেই ১টি কল এবং দিঘীর উত্তর পাড়ের ৩৫ পরিবারের জন্য নেই ১ টি কল, দিঘীর দক্ষিণ পাড়ের ২২ পরিবারের জন্যও নেই ১টি কল। মসজিদের উত্তরের বাড়ীর ১৭ পরিবারের জন্য নেই একটি কল।
একই এলাকার কিছু মানুষ পাচ্ছে না সরকারী নলকূপের সুবিধা, অথচ একই বাড়ির ৪ জন কিনা সরকারী নলকূপ নিজের বাড়ির সীমানায় স্থাপন করে ব্যক্তিগত ব্যবহার করছে। তাহলে সরকারী এসব প্রকল্প কি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য? প্রশ্ন সাধারণ জনগণের।
এসকল ব্যাপারে রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান মোশারফ হোসেন মুশু বলেন, আমরা নলকূপের জন্য আবেদন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীদের নিকট প্রেরণ করি। যাছাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। তারা কিভাবে কল বরাদ্দ দিয়েছে, এটা তারাই ভালো জানেন!
স্থানীয় মেম্বার বিল্লাল হোসেন একই বাড়িতে ৪ টি সরকারী কল স্থাপনের ব্যাপারে জানান, সরকারী নলকূপ দেয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না! এগুলো স্থানীয় চেয়্যারম্যান ও উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল আমার সাথে সমন্বয় না করেই বরাদ্দ দিচ্ছেন। তাই এর দায়ভার আমার নয়!
একই বাড়িতে ৪টি সরকারী নলকূপ স্থাপনের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। আশে পাশের মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অথচ একই বাড়ির মানুষ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বের অবহেলার কারণে সরকারী কলগুলো পেয়ে ব্যক্তিগত ব্যবহার করছে৷ বিষয়টি আমি দেখবো?
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম নলকূপ বরাদ্দের বিষয়ে বলেন, আমরা কোনো বরাদ্দ দিতে পারি না, বরং স্থানীয় এমপি ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়্যারম্যানদের সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা নলকূপ বরাদ্দ দেই।
নলকূপ বরাদ্দের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব কার, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে এটার দায়িত্বও আমাদের। আমাদের মাঠ কর্মী যাচাই-বাছাই রিপোর্ট দিলে আমরা তা প্রদান করি। তবে কয়েকটি জায়গায় দায়িত্বের অবহেলা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
একই বাড়িতে ৪টি সরকারী নলকূপের বরাদ্দের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি কলই আলাদা আলাদা অর্থ বছরে দেয়া হয়েছিলো। যদিও একই বাড়িতে ৪টি বরাদ্দ দেয়াটা উচিত হয় নি। বিষয়টি তদন্ত করে তিনি দেখবেন বলেও জানান।